অনিয়ম আর দুর্নীতি বাংলাদেশের একমাত্র গর্বের বিষয়
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সস্তা মানুষের প্রাণ। নিয়ম ভাঙার মহোৎসব চলে পুরোদমে। সেখানে আবার কিসের নিয়ম। অনিয়ম আর দুর্নীতি বাংলাদেশের একমাত্র গর্বের বিষয়।
আর কত মানুষ এইভাবে মারা গেলে সংশ্লিষ্টদের টনক নড়বে আল্লাহ মালুম। হে মহান রব, এদেরকে হেদায়েত দান করুন।
শরিফুল ভাই বলেছেন, বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় আগুনে মানুষের মৃত্যুর খবর নিয়ে যারা ঘুমাতে গিয়েছেন কিংবা সকালে ঘুম ভাঙার পর যারা ৪৫ জন মানুষের মৃত্যুর খবর শুনেছেন জানি না তাদের মনের অবস্থা কী! এতোগুলো মানুষের মৃত্যুতে আমার মতোই হয়তো ছটফট করছেন! কিন্তু যে পরিবারগুলোর স্বজনেরা চলে গেলো তাদের মনের অবস্থা চিন্তা করতেই স্তব্ধ হয়ে যাই! এই শহরের ৪৫ জন মানুষ, কেউ বুয়েটের ছাত্র, কেউ ব্র্যাকের, কেউ বিদেশে থেকে ছুটিতে এসেছেন! বৃহষ্পতিবার রাতে প্রিয়জনকে নিয়ে আনন্দে বাইরে খেতে গিয়েছিলেন, তাদের সেই আনন্দের রাতটা পরিনত হলো অনন্ত বিষাদের রাতে!
এই মৃত্যুর তালিকায় তো থাকতে পারতাম আমি আপনি যে কেউ। কারণ এই শহরে বাইরে খাওয়া ছাড়া মধ্যবিত্তের জীবনে খুব বেশি বিকল্পও তো নেই! তাহলে রেস্তোরাঁগুলো কেন নিরাপদ হবে না? কেন সেখানে আগুনের বিষয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থাকবে না? কেন নিয়মিত মহড়া হবে না? এক ভবনে এতো সিলিন্ডার থাকলে সেগুলোর নিরাপত্তা কার দেখার কথা? আচ্ছা একটা ভবনে কতোগুলো রেস্টুরেন্টে থাকতে পারে? কতোগুলো চুলা? কতোগুলো সিলিন্ডার? আচ্ছা আর কতো মানুষ আগুনে মরলে অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে হুঁশ ফিরবে?
শুনে অবাক হবেন এই ৪৬ জন মানুষ কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যায়নি। তারা মারা গেছে কালো ধোঁয়ায় যার মানে আগুন লাগার পর বের হতে না পেরে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু। আসলে আগুন লাগলে মানুষকে সেখান থেকে দ্রুত বের করে আনার মত পথ বা চর্চা দুটোরই ভীষণ অভাব বাংলাদেশ। এগুলো দেখার কেউ নেই।
অবশ্য বেইলি রোডের ঘটনার পর এখন তদন্ত কমিটি থেকে শুরু করে এসব আলোচনা শুনবেন। কিন্তু এগুলো যাদের দেখার কথা তারা কোথায় ঘুমাচ্ছিলেন এতোদিন? আচ্ছা এই ঘটনার দায়ে এই শহরের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা কেন জবাবদিহিতায় আওতায় আসবে না? এর আগে বনানীর ভবন থেকে শুরু করে প্রতিটি আগুনের ঘটনার পর কথা ছিল রাজধানীর প্রতিটি ভবন দেখা হবে। কেন হয়নি? এর দায় কার? কীভাবে চোখের সামনে এতোসব অনিয়ম চলে?
এসব কারণেই আমি এগুলোকে আর এখন দুর্ঘটনা বলি না। এগুলো হত্যাকাণ্ড! এগুলো সিস্টেমটিক ব্যর্থতা। কারণ অনিয়ম আর দুর্নীতি। এই যে এই দেশে আপনি খেতে গিয়ে মরবেন, হাসপাতালে সুন্নতের খতনা করতে গিয়ে মরবে আপনার সন্তান, এন্ডোসকপি করতে গিয়ে মরবে আপনার ভাই, নির্মাণাধীন ভবনের রড পড়ে মারা যাবে কোন বাবা, বাস দুর্ঘটনা, ট্রেনে আগুন কিংবা ভবনের আগুনে মারা যাবে সাধারণ মানুষ, গার্মেন্টস বা কারখানায় মরবে শ্রমিক প্রত্যেকটা মৃত্যুর দায় এই রাষ্ট্রের! এমন কোন দিন নেই এদেশে অবহেলায় মৃত্যু হচ্ছে না।
ভীষন কষ্ট লাগে। সাংবাদিক হিসেবে গত দুই যুগে কতো যে দুর্ঘটনা আর কতো যে লাশ দেখেছি! সাভারের নিশ্চিন্তপুর মাঠে তাজরীন ফ্যাশনের পুড়ে যাওয়া ১১১ শ্রমিকের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশগুলো সারি সারি করে রাখা ছিল। লাশ না কঙ্কাল, বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া কঙ্কালসম শরীরের কানে সোনার দুল দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন রাজবাড়ির মোহাম্মদ শোয়েব। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, এটাই তার স্ত্রী শিউলির লাশ। সোনার এই দুলটা তিনি স্ত্রীকে কিনে দিয়েছিলেন।
আমি সেই আহাজারি কখনো ভুলিনি। আজকেও ফের সেই আহাজারি! কতো যে মৃত্যু দেখলাম দুই যুগে! বহুবার লিখেছি এই দেশে বাস বা লঞ্চের যে কোন দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে সন্তানের মৃত্যুর পর জানা যায় হাসপাতালের অনুমোদন নেই। আগুন লাগার পর জানা যায় ভবনের অনুমোদন নেই। আগামী কয়েকদিন আপনারা শুনবেন কীভাবে এক ভবনে এতেোগুলো রেস্তোরা হলো? কীভাবে তারা অনুমোদন পেল? বারবার এমন হয়।
বাস্তবে হাসপাতালে অবহেলায় মৃত্যু বলেন, ভবনে আগুন, বাস দুর্ঘটনা কিংবা প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা! এগুলো দেখার জন্য নানা কর্তৃপক্ষ ছিল। কিন্তু মানুষ মরে যাওয়ার আগে তাদের কারো হুঁশ হয় না। মরে যাওয়ার পর শুনবেন তদন্ত কমিটি, শুনবেন ভবন নির্মানে ত্রুটি, অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা নেই, এই অনুমোদন ছিলো না, সেই অনুনোমদন ছিলো না আরো কী! অথচ এসব দেখার জন্য রাজউক বলেন, বিআরটিএ বলেন, ওয়াসা বলেন, তিতাস বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেন কতো যে সরকারি সংস্থা আর মন্ত্রনালয় আছে! কিন্তু প্রত্যেকটা সরকারি সেবা সংস্থার সবাই যেন ঘুমায়! সেখানে গড়ে ওঠে দুর্নীতির পাহাড়। প্রতিবারই মৃত্যুর ঘটনার পর নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়, নানা আলোচনা হয়, তারপর আমরা ফের অপেক্ষা করি নতুন কোন দুর্ঘটনার!
আচ্ছা স্বাধীনতার তো ৫৩ বছর হলো! এভাবে আর কতদিন চলবে? আচ্ছা স্বজন হারাদের এই আর্তনাদ কতোকাল চলবে? আর কতো মানুষ মরলে আমাদের হুশ হবে? আর কবে সুশাসন আসবে? আর কতো শতো মানুষ মরলে, এই শহরটা কতোটা ধ্বংস হলে নীতি নির্ধারকদের বোধ জাগবে? আর কতো মানুষ মরলে তদারকি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা আসবে? আর কতো মানুষ মরলে আমাদের মনে হবে এবার অন্তত ঠিক করি। জানি না এই যে ঢাকা শহরটাকে আমরা মেরে ফেলছি, ধ্বংস করছি পুরো দেশ এর শেষ কোথায়?
আমি বিশ্বাস করি, নীতি নির্ধারকেরা চাইলে, আমরা সবাই মিলে চাইলে এই দেশের প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সুশাসন। প্রয়োজন জবাবদিহিতা। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য শাস্তি দিতে হবে। ভালো করলে পুরস্কার। যারা দেশ চালান, আপনারা যারা ক্ষমতাবান, আপনারা যারা নীতি নির্ধারক, আপনাদের কাছে হাতজোড় করে বলি, উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় ভবন নয় সেখানে জবাবদিহিতা ও সুশাসন জরুরি। আপনাদের দোহাই লাগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন প্রতিটা খাতে।
দেখেন এই দেশটা আমাদের! যারা মরছে তারা আমাদের স্বজন। কাজেই চলুন সবাই মিলে দেশটাকে ঠিক করি। আপনাদের দোহাই লাগে জেগে উঠুন! আপনাদের বোধ ছাড়া এই দেশকে বাঁচানোর কোন উপায় নেই! কাজেই আল্লাহ তুমি আমাদের বোধ দাও! বিশেষ করে বোধ দাও আমাদের নীতি নির্ধারকদের! তাদের ঘুম ভাঙাও! নয়তো এমন আহাজারি চলতেই থাকবে!