এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠার নয়
এই ছবিতে অসীম প্রাণশক্তি আছে। ৮০ উর্ধ্বো বয়সে শরীরে হাজারো রোগের যন্ত্রণা নিয়েও কি করে এমন হাস্যোজ্জ্বল থাকা যায় তা এই ছবি প্রমাণ।
ঘামের পানিতে ভিজে একেবারে মলিন হয়ে যাওয়া একটা হাফহাতা শার্ট পরে আছে মানুষটি,একেবারে সাদামাটা একটা প্রতিচ্ছবিই আমাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে ডাঃ জাফরুল্লাহ স্যারের।এভাবেই আমরা চিনেছি মানুষটাকে।
অথচ ৬০ এর দশকে লন্ডনে পড়াশোনা অবস্থায় রাজকীয় দর্জি তার বাসায় এসে মাপ নিয়ে স্যুট তৈরি করতেন বলে দর্জিকে অতিরিক্ত ২০ পাউন্ড করে পরিশোধ করতেন। খুব বিলাসী জীবনের কথা ভাবা বড়লোকের সন্তানেরা চায় চার চাকার লাইসেন্স নিতে।অথচ এই মানুষটার নেওয়া ছিলো পাইলটের লাইসেন্স।
এমন বিলাসী জীবনকে ত্যাগ করছে একমাত্র সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে।
১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস শেষ করে লন্ডনে পাড়ি জমান উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য৷
বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে নিরেট এই দেশ প্রেমিক চলে এসেছিলেন দেশে,একমাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য লড়বেন বলে।
বৃটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিডিএমএ)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে লন্ডনের হাইড পার্কে যে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন তাদের একজন ডা. চৌধুরী। তারপর বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা।
বুকের ভিতর কতটুকু দেশপ্রেম ও প্রতিবাদের আগুন থাকলে এমন কাজ করা যায়!
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপিটাল” নামে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তুলতেন তার এই হসপিটাল।
এই মানুষটা সারাজীবনই এই বাংলাদেশের মানুষের জন্য করে গিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে এরপর এই দেশের মানুষের জন্য শুরু হয় তার স্বাস্থ্যযুদ্ধ। এই যুদ্ধ ছিলো দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চতকরণের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকালীন ফিল্ড হসপিটালকে পরবর্তীতে “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র” নামে নামকরণ করে শুরু হয় তার যুদ্ধ। এই দেশের গণমানুষকে বাঁচাবার যুদ্ধ।
জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে প্রণয়ন করেন ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি। জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে প্রণয়ন করেন “অগ্রসর শিক্ষা নীতি”।
গণস্বাস্থ্যের পর তার ম্যাগনাম ওপাস হচ্ছে ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষুধ নীতি। স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যখাতে যেটাকে বিবেচনা করা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে। তার প্রচেষ্টায় আমদানি ওষুধের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান ছিলেন তিনি।
‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ছিল তখন এদেশের মধ্যবিত্তের মৌলিক একটি প্রকাশনা। সর্বোচ্চ প্রচারণা ছিল বিচিত্রার প্রধান হাতিয়ার। সত্তর দশকের বিচিত্রায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী প্রমুখ ছাড়া হাতেগোনা যে ক’জন বিচিত্রার প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিলেন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের একজন।
অথচ এই নিরেট দেশপ্রেমিক মানুষটিকে সময়ে সময়ে এই দেশের মানুষ নিজের আঁতে ঘা লাগার কারণে অপমান করতে ছাড়েনাই।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯৯২ সালে তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল বিএমএ। বিনা বিচারে তার ফাঁসি চেয়ে পোস্টারও সাঁটিয়েছিল।
পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া নিজের জমিটুকু পর্যন্ত ভাই-বোনদের উৎসর্গ করে দেওয়া এই মানুষটার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিলো ভূমি দখলের।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেওয়া এই নির্লোভ মানুষটাকেও শুনতে হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।
অথচ বাংলাদেশে একমাত্র তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করতে পারেন দরিদ্র মানুষ।
১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৫ সালে বিকল্প নোবেল খ্যাত র্যামন ম্যাগসাই পুরষ্কার সহ সুুইডিশ ইয়ুথ পিস প্রাইজ, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, সুইডেনের লাইভ লাই হুড পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ’ পুরস্কার সহ অসংখ্যা পুরষ্কার রয়েছে এই মানুষটির অর্জনে।
একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়ে গেলো। কয়েক’শ বছরেও একজন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী তৈরি হয়না।
সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকা মানুষটিকে আল্লাহ এই দেশের মানুষের দোয়ার বদলৌতে ক্ষমা করে দিয়ে কবুল করে নিক!
এই বাংলাদেশ আপনাকে মিস করবে স্যার!