অযৌক্তিক আইনগুলিকে পরিবর্তন করে যুগোপোযগী করুন

নাজমুস সাকিব শিশির ভাই বলেছেন, একটা সমাজ ও দেশে জনগণের সন্মান, নিরাপত্তা ও শৃংখলা রক্ষার জন্য বিধি-বিধানের সমষ্টি হচ্ছে আইন। যে দেশের আইন যতো কার্যকর এবং এর প্রয়োগ যতো কঠিন, সেই দেশ ততোটা সভ্য ও উন্নত।

বাংলাদেশে কিছু বিশেষ আইন ছাড়া দেওয়ানি এবং ফৌজদারী সহ সব ধরনের আইনের প্রায় পুরোটাই বৃটিশদের প্রণীত, যার অনেকগুলিই এই সময় এবং জনগণের মন-মানসিকতার সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং হাস্যকর। শুধু তাই না, এসব আইনের কারণে বিচারপ্রার্থীরা সুবিচার লাভে ব্যার্থ হচ্ছে এবং আইনের অপব্যহারও অবাধে হচ্ছে। কিছু উদাহরণ দিলেই ব্যাপার গুলি ষ্পষ্ট হবে।
আদালতে এখন যত মামলা আছে তার ৭০ শতাংশ জমি সংক্রান্ত দেওয়ানী মামলা এবং এর বেশিরভাগই জমির দখল বিষয়ক মামলা। আর এসব মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। দেওয়ানি মামলায় আসামীদের কারাদন্ড প্রদানেরও বিধান রাখা হয়নি।

কোনো জববরদখলকারী সন্ত্রাসী ক্ষমতা প্রয়োগ ও ভীতি প্রদর্শন করে কারো জমি দখল করলে তার প্রচলিত আইনে প্রতিকার পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। দন্ডবিধির ৩৮৩ ধারায় স্থাবর সম্পত্তি দখল চাদাবাজির অপরাধ বলা হলেও এই ধারায় কারোর বিরুদ্ধে মামলা বা শাস্তি হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। অথচ জমি দখলের মতো একটা মারাত্মক অপরাধের জন্য ফৌজদারী আইন থাকা খুবই প্রয়োজন ছিলো যার অভাবে এই অপরাধ অবাধে ঘটছে।

দেশে জমির ভোগ-দখল সংক্রান্ত যে আইনটি রয়েছে তা ব্রিটিশ আমলের। ১৮৮৫ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে অনেক আইনের পরিবর্তন হলেও ভূমি আইন আগের মতোই রয়ে গেছে। এতে কারও জমি অন্যজন ১২ বছর ভোগ-দখল করলে সেই জমির মালিকানা পাওয়ার সুযোগ ছিল। সেই আইনও পাল্টানো হয়নি। এর ফলে অনেকে নিজেদের জমির মালিক দাবী করে উল্টা প্রকৃত মালিকেদের বিরুদ্ধেই মামলা করে।

দন্ডবিধি ১৬১ ধারায় সরকারী কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণের শাস্তি মাত্র ৩ বছরের কারাদন্ড। এই নামমাত্র শাস্তির কারণে তাদের এক বিরাট অংশ ঘুষ দুর্নীতির সাথে যুক্ত। বৃটিশরা তাদের প্রশাসন পরিচালনার স্বার্থে সরকারী কর্মচারীদের জন্য এই লঘুদন্ড তৈরী করেছিলে কারণ তাদের বড় অংশই দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলো। স্বাধীন দেশের জন্য এই আইন মোটেও উপযোগী না। অথচ কোনো বেসরকারী কর্মচারী চুরি করলে তার শাস্তি ৭ বছরের কারাদন্ড হবে বলে ৪০৮ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে।

দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় পরকিয়া সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ বিবাহিত কোনো মহিলার সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত হলে সেই পুরুষের ৫ বছরের কারাদন্ড হবে কিন্ত মহিলার কোনো শাস্তি হবে না। এই আইনটা চরম হাস্যকর কারণ প্রাপ্তবয়স্ক দুইজন ব্যাক্তি অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হলে শুধ ‍পুরুষকে এজন্য দায়ী করা চরম বৈষম্যমূলক। এই্ আইনেও অনেক পুরুষের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনো নারীর বিরুদ্ধে হয়নি।

তবে দন্ডবিধির যে ধারাটার সবচেয়ে বেশী অপপ্রয়োগ এবং মিথ্য ও হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে সেটা ৩৭৫ ধারায় বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা। এই আইনটা যখন করা হয়, সেই ১৮৬২ সালে প্রেক্ষিতে এটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত একটা আইনটা ছিলো।

কারণ সেই সময়ে এধরণের সম্পর্ক জানাজানি হলে এবং কোনো নারী গর্ভধারণ করার পর দায়ী ব্যাক্তি তাকে বিয়ে না করলে তাকে সমাজচ্যুত হতে হতো। কিন্ত দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমের অনুকরণে বাংলাদেশেও প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষদের বিরাট অংশ অবাধ সম্পর্কে জড়িত। এই্ অবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আইনটার অপব্যবহার হচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে একাধিকবার বিবাহিত নারীদেরও অনেকে ৩০-৪০ বছর বয়সে সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ব্যাক্তিগত আক্রোশের কারণে এই আইনে মামলা করছে। সম্প্রতি একটা টিভি চ্যানেলের একজন সংবাদপাঠিকা এবং চিকিৎসক তারই এই বিবাহিত সহকর্মীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেছে। অথচ এই মহিলা তার সম্মতিতে উক্ত ব্যাক্তি সাথে পরকিয়া সম্পর্কে জড়িত হলেও আইনগত সুবিধার জন্য তার বিরুদ্ধে সেই মামলাও করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশেও শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জন্য বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের এই আইনটা রাখা উচিত কিন্ত কোনোভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক বা বিবাহিতদের জন্য না।
বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার অর্থ সবসময় ধর্ষণ নয় বলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রায় দিয়েছেন দিল্লি হাইকোর্ট। আদালত বলেন, একজন নারী যদি তার নিজের সম্মতিতে দীর্ঘদিন শারীরিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন, তাহলে এটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণ বলা যাবে না।

ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট যথাক্রমে ৫ বছরের কারাদন্ড এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, ৩ বছরের কারদন্ড এবং ৫ হাজার টাকা এবং ২ বছরের কারাদন্ড ও ২ হ্াজার টাকা লাখ অর্থদন্ড দিতে পারবেন, যা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত অপ্রতুল। অর্থদন্ডের সংখ্যা হওয়া উচিত ১০, ৫ ও ৩ লাখ। তাদের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতাও বাড়ানো দরকার।

দন্ডবিধির ৫১০ ধারায় মদ খেয়ে মাতলামির শাস্তি মাত্র ১০ টাকা অর্থদন্ড এবং ২৪ ঘন্টা কারাদন্ড বলে উল্লেখ আছে যা একেবারেই তুচ্ছ শাস্তি। এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৬ মাস কারাদন্ড এবং ১০ হাজার টাকার অর্থদন্ড করা দরকার।

সম্পত্তি কেনা এবং ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানো যাবে না বলে অযৌক্তিক একটা আইন আছে। বাংলাদেশের ধনীদের বিরাট একটা অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থশালী হলেও দেশে উত্তরাধিকারসূত্রে এবং বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে সৎপধে ধনী হওয়া ব্যাক্তিদের সংখ্যাও কম না।
ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল, বসবাসের অযোগ্য, দুষিত এবং যানজটের শহর। বৈধভাবে ধনী ব্যাক্তিরা যদি নিজের আয়ের টাকা দিয়ে বা দেশে থাকা সম্পত্তি বিক্রি করে সম্পত্তি কিনে উন্নত দেশগুলিতে বসবাস করতে চায়, তাহলে তাকে বাধা দেয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এই সুযোগের অভাবে দুর্নীতিবাজদের মতো বৈধভাবে ধনী ব্যাক্তিরাও হুন্ডির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়ে বসবাসের সুবিধা নিচ্ছেন।

দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ণের মতো নির্দিষ্ট একটা কর প্রদানের বিনিময়ে বিদেশে সম্পত্তি কেনার সুযোগ দেয়া দরকার। অনুমতি প্রদানের সময় তার সব অর্থ-সম্পদ যে বৈধ উপায়ে অর্জিত, এব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার বিধানও রাখতে হবে।
উল্লেখিত অযৌক্তিক আইনগুলি বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রনয়ণের মতো নিজস্ব আইন তৈরী করা হলেই আর এসব সমস্যা থাকতো না।

সুতরাং দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে প্রবীণ আইন গবেষক,আইনজীবি,বিচারক এবং মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে একটা সংস্থা গঠন করার মাধ্যমে দেশে প্রচলিত অযৌক্তিক আইনগুলিকে পরিবর্তন করে যুগোপোযগী করা দরকার।

Maniruzzaman

I am Maniruzzaman, a free thinker and political commentator, dedicated to unraveling the complexities of Bangladesh’s political landscape.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button