সব কাঁচামাল বিদেশ থেকেই আসে
যারা পোশাকের ক্রয় আদেশ হারানোর ভয় দেখান, তাদের যে মিনিমাম লেভেলের বাস্তবজ্ঞান নেই, সেটা বোঝার জন্য পড়ুন।
লালসালু ভাই বলেছেন, আপনি কি জানেন?
বাংলাদেশ প্রতি বছর যদি ১ হাজার কোটি টাকার পোষাক বিদেশে রপ্তানি করে তাহলে তার মধ্যে মিনিমাম ৮৫০ কোটি টাকা বিদেশেই চলে যায়?
মানে আমরা পাই শুধুমাত্র মজুরির ১০ থেকে ১৫%
কখনো কখনো সামান্য বেশি কখনো কখনো আরো কম!
কেন জানেন?
কারণ একটা জামা সেলাই করতে কাপড়, কাপড়ের কাঁচামাল, সূতা, বুতাম, বুতামের কাঁচামাল, এক্সেসরিজ থেকে শুরু করে পলি কার্টন সব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আসে।
মানে আমরা যদি কোন গেঞ্জির অর্ডার ১০০ টাকা পিসে নেই তাহলে এর মধ্যে শুধুমাত্র মজুরির ১০ টাকা আমরা পাই বাকীগুলো মানে কাঁচামাল বিদেশে থেকে কিনতে গেলে ৯০ টাকা বিদেশেই চলে যায়।
বিদেশীরা আমাদের দেশ থেকে পোষাক কেনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে একটা কারণ হলো স্বস্তা মজুরি। আমাদের দেশে একটা আইটেমের মজুরি যদি ১০ টাকা লাগে ভারতের লাগে ১৫ টাকা, শ্রীলঙ্কার ২০ টাকা, চায়নার ৩০ টাকা।
আপনারা যারা ব্যবসায়ী তারা ভালো করেই জানেন ব্যবসায় ১ টাকার কত গুরুত্ব! এই গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশ থেকে চাইলেও গার্মেন্টস সেক্টর রাতারাতি অন্য দেশে ট্রান্সফার করা সম্ভব না। মানে বিদেশীরা চাইলেও আমাদের দেশে অর্ডার না দিয়ে আরেক দেশে অর্ডার দিতে পারবে না।
আমি আপনাদের একটা উদাহরণ সহ বুঝিয়ে দিচ্ছি।
ধরুন আপনি এলাকার মুদী দোকানের বান্ধা কাস্টমার। এখান থেকে আপনি ৫০ টাকা কেজি দরে চাল কিনেন। বাসা থেকে হেঁটে যাওয়া আসা করেন। দোকানদার আপনাকে বাকীতে মাল দেয়। আপনি দোকানে না গিয়েও ফোন করলে আপনার বাসায় সামান্য চার্জের বিনিময়ে বাসায় চাল ডাল দিয়ে যায়। এই সম্পর্ক আপনার সাথে একদিনে হয় নি। অনেকদিন লেগেছে এই বিশ্বাস স্থাপন করতে।
এখন কোন কারণে আপনার সাথে দোকানদারের ঝামেলা হলো। আপনি রাগ করে সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি তার কাছ থেকে কোন পণ্য কিনবেন না। তাহলে কী হবে?
আপনাকে বাধ্য হয়ে অন্য এলাকার দোকানে যেতে হবে যেখানে আপনাকে বাকী দিবে না। ফোনে অর্ডার করলে বাসায় পৌছে দিবে না। ৫০ টাকা চালের দাম ৬০ টাকা রাখবে। এছাড়া যাতায়াত ভাড়াও পড়বে যেতে আসতে ৬০ টাকা। আপনি হয়তো রাগ করে দূরের দোকান থেকে নিজে খাওয়ার জন্য চাল কিনতে পারেন কিন্তু ব্যবসার জন্য কোনভাবেই রাগ করা চলবে না। আপনি সেই দোকানে যেতে বাধ্য হবেন।
আমিও যেহেতু ছোটখাটো ব্যবসা করি তাই আমিও আমার চরম অপছন্দের কয়েকজনের কাছ থেকে পণ্য প্রায়ই কিনি। অপরদিকে চাইলেও পছন্দের ব্যাক্তির কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারি না। এটাই ব্যবসার সাইন্স! এই সাইন্স শুধুমাত্র ব্যবসায়ীরাই বুঝবে।
বাংলাদেশ থেকে আরেকটা কারণে রাতারাতি গার্মেন্টস সেক্টর অন্য দেশে চলে যাবে না। কারণ কী জানেন?
কারণ হলো পানি!
হ্যা, এই পানির জন্য এক সময় দুনিয়ায় বিশ্বযুদ্ধ হবে এখন যেমন তেলের জন্য হচ্ছে। এটা আমার কথা না।
একটা অদ্ভুত কথা বলে নিচ্ছি। এক পিস পোষাকের জন্ম থেকে কাস্টমারের হাতে পৌছানো পর্যন্ত ১৯০ লিটার পানি লাগে! আপনি এত পানি কয়টা দেশে পাবেন?
আপনি চাইলেও যেকোনো পানি দিয়ে কাপড় সূতা ওয়াশ করতে পারবেন না, বানাতে পারবেন না। বাংলাদেশের পানিতে PH এর মাত্রা যেটা আছে সেই মাত্রার PH অনেক দেশের পানিতে নেই। ভারতের অনেক রাজ্যে এখনো খাবার পানি সংকট, কাপড় বানানো দূরের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা তো সবাই জানেন। সেখানে পানির চেয়ে তেলের দাম কম। তেল দিয়ে তো আর কাপড় বানানোর প্রসেস করা যাবে না। আমাদের মত ফ্রী পানি তারা পাবে না।
গার্মেন্টস শিল্প শুধুমাত্র গরিব দেশের ব্যবসা। ধনীরা এটা কখনো করবে না কারণ এরে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হয়।
এশিয়ার মধ্যে যারা গরিব দেশ তাদের বেশিরভাগ পানি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সমস্যা। যেমন সব দেশে পোর্টই নেই। আর পোর্ট থাকলেও আমাদের মত নেই। আর নতুন কোন দেশে এই শিল্প গেলে সেখানকার লোকজন দক্ষ হতে হলে মিনিমাম ১০ বছর লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা দূর্ণীতি না থাকলে এই শিল্প দাঁড়াবে না। দুর্নীতির সাথে গার্মেন্টস শিল্পের নিবিড় সম্পর্ক! এজন্য শুধুমাত্র ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার কয়েকটা দেশে এই শিল্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশের টেনশনের তেমন কিছুই নেই। চায়ানারা ধনী হয়ে যাচ্ছে, তারা পরিবেশ বিষয়ে সচেতন। তারা গার্মেন্টস শিল্প ছেড়ে দিচ্ছে এবং আফ্রিকা ও ভিয়েতনামে নিজেদের অর্ডারগুলোই প্রসেস করছে। এই যে বাংলাদেশ পর পর দুই বছর রপ্তানীতে ২য় থেকে ৩য় হলো তাতে কিন্তু আমাদের কোন অর্ডার কমে নাই বরং বেড়েছে। ভিয়েতনাম যে ৫ থেকে হঠাৎ করে ২য় হলো তাদের অর্ডার এসেছে চায়নার ফেলে দেয়া অর্ডার থেকে।
চায়না বিশ্বের ৭২% পোষাক বানায়।
২য় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ বানাত মাত্র ৮ বা ৯%
মানে চায়না যদি তার অর্ধেক অর্ডারও ছেড়ে দেয় তাহলে বাংলাদেশের মত ৫ টা ঘণ বসতিপূর্ণ দূর্নীতিবাজ দেশ লাগবে। যে দেশে পানি থাকবে, পোর্ট লাগবে, চায়না থেকে কাঁচামাল আমদানীতে কম সময় লাগবে এবং রপ্তানিতে যথেষ্ট সুযোগ থাকা লাগবে। এগুলো ভিয়েতনামে একদিনে তৈরি হয় নি। মিনিমাম ২০ বছর লেগেছে এই অবস্থানে আসতে।
এই পোস্টে দেয়ার উদ্দেশ্য কী জানেন? যারা ভাবছেন ফ্রান্স যদি বাংলাদেশ থেকে পোষাক কেনা বন্ধ করে দেয় তাহলে তারা বিকল্প দেশে চলে যেতে পারে কারণ ফ্রান্স হলো ইউরোপের ৩য় দেশ যারা বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পোষাক আমদানি করে।
গার্মেন্টস সেক্টরে দীর্ঘ ১৫ বছর চাকরি করেছিলাম। ফ্রান্সের মালিনাধানী প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করেছি। সেই মালিক ফ্রান্সের ১২ বা ১৩ নম্বর ধনী! আমাদের দরবেশ বাবার মত দু চারটা দরবেশ ওনার এক পকেটেই থাকে।
ফ্রান্সের কম হলেও ২০ টা বায়ারের কাজ করেছি। ওরা ঝানু ব্যবসায়ী। আমাদের দেশে রাজনীবিদরা যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলে কিন্তু সেই দলের ব্যবসায়ীরা পাকিস্তানের সাথে ব্যবসা করে ঠিক তেমনি ফ্রান্সের অবস্থা সেইম৷ তাদের ব্যবসায়ীরা সামান্য ১ সেন্ট মানে ৮০ পয়সার জন্য চায়না থেকে বাংলাদেশে অর্ডার প্লেস করে। আবার সামান্য ১ সেন্ট কম পেলে বাংলাদেশ থেকে আরেক দেশে অর্ডার নিয়ে যায়। তখন বুঝেছি ফ্রান্স কেন বিশ্বের টপ লেভেলের ধনী দেশ হয়েছে! কারণ তারা হিসাবে পাকা। ফ্রান্সের এক বায়ারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ১ সেন্ট বেশি দিয়ে অর্ডারটা বাংলাদেশে প্লেস করতে পারো না?
তিনি উত্তর দিলেন “সেটা বুঝতে পারলে তো তোমরা বিশ্বের সেরা ধনী হতে!”
সুতরাং যারা ভাবছেন ফ্রান্স বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলে বাংলাদেশের ক্ষতি তারা ভুল বুঝছেন। তবে ফ্রান্স যদি বাংলাদেশীদের সেদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয় তাহলে অবশ্যই ক্ষতি হবে কারণ পোষাক রপ্তানীর ১০% বাংলাদেশ পেলেও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এর পুরো টাকাটাই বাংলাদেশ পায়!
যে কথা এর আগেও একটা পোস্টে বলেছিলাম, যখন আমরা কৃষি নির্ভর ছিলাম তখন আমরা ছিলাম দুনিয়ার সেরা ধনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন কাজ করতে ব্যবসা করতে এ তল্লাটে আসত। যেই না আমরা কৃষিকে ভুলে গিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে চলে গেছি সেই কৃষি ইন্ডাস্ট্রির দখল নিল উন্নত দেশগুলো। এখন তারা আমাদের কাছে কৃষি পণ্য বিক্রি করে। এর মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। বেঁচে থাকতে হলে আমাদেরকে যে করেই হোক কৃষিতে ফিরে যেতে হবে। কৃষি কাজ করে এখন লাভ নেই কারণ আয়ের চেয়ে ব্যায় বেশি। সবাই যদি এই সেক্টরে নামে তাহলে এটা নিয়ে গবেষণা হবে, কস্টিং কমবে আর তখন লাভের মুখ দেখা যাবে।