টাকার লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মানব কিডনি, চক্রের সাথে জরিত কারা?

মনিরুজ্জামান
অভাবের তাড়নায় নিজের কিডনি বিক্রির মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে জামালপুরের কিশোর এরশাদ বাবু (২২)। জামালপুরের এক কিডনি পাচার চক্র তাকে বিভ্রান্তিকর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফাঁদে ফেলে, যেখানে প্রলোভন হিসেবে সরকারি চাকরি এবং নগদ অর্থের লোভ দেখানো হয়। কিন্তু কিডনি অপারেশনের পর প্রতিশ্রুতির কোনো কিছুই পূরণ করেনি দালাল সগীর আহমেদ। বরং অপারেশনের পরে তাকে চিনতেও অস্বীকার করে প্রতারক চক্রটি।

এই কিডনি পাচার চক্রের শিকার হয়ে এরশাদের পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে গেলে কোনো ধরনের সহযোগিতা পায়নি। সরিষাবাড়ী থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েও পুলিশ জিডি নিতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অভিযোগ জমা হলেও তাতেও সাড়া মেলেনি।

এদিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে এরশাদের কিডনি সগীর আহমেদের ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই অপারেশনের কাগজপত্র সরবরাহ করতে রাজি নয় এবং কোনো মন্তব্যও করতে চায়নি।

এরশাদ বাবুর সাথে কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের প্রতারণার এই ঘটনাটি আমাদের কাছে আসার পর আমরা এটি নিয়ে আরো বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করি। এরপর বেরিয়ে আসে লোমহর্ষক সব ঘটনা।

ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও অভিনব পদ্ধতিতে প্রচারণায় যুক্ত আছে এই সিন্ডিকেট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক, এখন কিডনি কেনাবেচার সক্রিয় বাজারে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক গ্রুপে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কিডনি নিয়ে দর-কষাকষির ঘটনা নিয়মিতই দেখা যায়। অনেক প্রলোভিত বিক্রেতা, যারা অতীতে নিজের কিডনি বিক্রি করেছিলেন, বর্তমানে এই অবৈধ ব্যবসার দালালে পরিণত হয়েছেন।

এই কেনা-বেচার মাঝখানে কাজ করছে শক্তিশালী দালাল চক্র, যারা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দরিদ্র কিডনি দাতাদের নানাভাবে প্রতারিত করছে। কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিস্থাপনের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের হিসেবে দেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন, অথচ আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে এই চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তাই সম্পদশালী ব্যক্তিরা বিদেশে গিয়ে প্রতিস্থাপন করাচ্ছেন, আর দেশে চাহিদা মেটাতে দালালদের সাহায্য নিচ্ছেন।

দালাল চক্র প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেয়; কার শরীর থেকে কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব তা খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে কিডনিদাতার স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিদেশে পাসপোর্ট-ভিসার বন্দোবস্তসহ প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু তারা নিশ্চিত করে। কিডনি দাতা ও গ্রহীতা, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, আইনজীবী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এমনকি একজন সিনিয়র সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এই চক্রটি পরিচালিত হচ্ছে।

অনুসন্ধানকালে, অভাবের চাপে ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করা এক যুবকের সন্ধান আমরা পেয়েছি, যিনি রাজধানীর একটি বৈদ্যুতিক তার প্রস্তুতকারী কোম্পানিতে কম বেতনে কাজ করেন। নিরাপত্তার কারণে তাঁর পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ সামাল দিতে তিনি ২০১৮ সালে ফেসবুকের একটি কিডনি কেনাবেচা গ্রুপে যুক্ত হন। দুই দালাল অহিদুল এবং মোজাহারের সঙ্গে আলোচনা করে ১০ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রিতে রাজি হন তিনি।

দালালদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি দিল্লিতে যান এবং কয়েক দফা পরীক্ষার পর তাঁর কিডনি অপসারণ করা হয়। হাসপাতাল থেকে তাঁকে দেশে ফেরার সময় মাত্র ২ লাখ টাকা ও পাসপোর্ট দেওয়া হয়। বাকি টাকার জন্য দাবি করলে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়। দেশে ফিরে তিনি দ্রুত নম্বর ও বাসা বদলে ফেলেন এবং ঘটনাটি পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখেন।

এই যুবক জানান, তিনি সেখানে আরও কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা করেন, যারা কিডনি বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। দালালচক্রের প্রধানের নাম সাইফুল ইসলাম বলে জানা গেছে।

ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে কিডনি কেনাবেচার চিহ্ন মিলছে। এমন এক হাসপাতালে টয়লেটের দেয়ালে দেখা গেছে কিডনি কেনাবেচার বিজ্ঞাপন, যাতে বেশ কিছু মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, যা মূলত দালালদের। জানা গেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও কিডনি বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, কিডনি ক্রেতা, বিক্রেতা এবং মধ্যস্থতাকারী দালালদের একটি চক্র ভারতের কলকাতা ও দিল্লির নির্দিষ্ট কিছু হোটেল ও হাসপাতালে গিয়ে কিডনি কেনাবেচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব পরিচয় ও চুক্তির সূত্রপাত হয় ফেসবুকে।

কিডনির হাট

এই জেলা যেন কিডনির হাটে রূপান্তরিত হয়েছে। উচ্চ সুদের ঋণে জর্জরিত ও দরিদ্র মানুষদের ফাঁদে ফেলে কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কালাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, একসময় নিজেরা কিডনি বিক্রি করা ব্যক্তিরাই এখন দালাল হিসেবে কাজ করছেন। এই চক্রটি তিন স্তরে কাজ করে: স্থানীয় দালাল প্রথমে দরিদ্রদের প্রলোভন দেখিয়ে ঋণ দেন, তারপর ঢাকায় নিয়ে দ্বিতীয় স্তরের দালালদের কাছে হস্তান্তর করেন। তৃতীয় স্তরে রয়েছে কিছু অসাধু চিকিৎসক ও ক্লিনিক, যারা কিডনি অপসারণের কাজ করেন।

দারিদ্র্য ও লোভের ফাঁদে পড়ে বহু মানুষ কিডনি বিক্রির পথে নামছে। উপজেলায় অন্তত ৩৫টি গ্রামে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, যেখানে পাঁচ শতাধিক মানুষ ইতিমধ্যে কিডনি বিক্রি করেছেন।

এছাড়া, স্থানীয় পর্যায়ে কিছু ব্যক্তি এলাকায় দরিদ্র ব্যক্তিদের ২০-৩০ হাজার টাকা ধার দিয়ে পরে কিডনি বিক্রি করতে প্রলুব্ধ করে। তারপর তারা ভুক্তভোগীদের ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন ধাপে চক্রের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের শরীর থেকে কিডনি অপসারণে সহযোগিতা করে।

জগন্নাতপুর গ্রামের এক দরিদ্র ব্যক্তি কিডনি বিক্রির উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যরা জেনে যাওয়ার ফলে তিনি এ বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। গত ৩০ মে কালাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে এই বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

ওই ব্যক্তির সেলুনে নিয়মিত চুল কাটাতে আসতেন একই গ্রামের এক সচ্ছল ব্যক্তি, যিনি চুল কাটার পারিশ্রমিক ছাড়াও নিয়মিত বকশিশ দিতেন। এমনকি দরিদ্র ওই ব্যক্তি প্রায় পাঁচ হাজার টাকা ঋণীও হয়ে যান তার কাছে। একপর্যায়ে ওই সচ্ছল ব্যক্তি তাকে কিডনি বিক্রির পরামর্শ দেন এবং ঢাকায় নিয়ে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করান। তবে পরবর্তী সময়ে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে, তিনি পাসপোর্ট করে বিদেশে গিয়ে কিডনি বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন।

দরিদ্র ব্যক্তির যাত্রা শেষ পর্যন্ত ভারতে পৌঁছায়নি, তবে একই অঞ্চলের একজন ব্যক্তি চার লাখ টাকায় একটি কিডনি বিক্রির চুক্তি করে ভারতের বেঙ্গালুরুতে গিয়ে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় দেশে ফিরে আসেন।

কালাই থেকে পাঁচবিবি: কিডনি বেচাকেনার উৎসব

কালাই উপজেলা বারবার কিডনি বেচাকেনার জন্য আলোচিত হয়েছে। স্থানীয় দরিদ্র মানুষদের লক্ষ্য করে অর্থলোভী দালালরা কিডনি বিক্রির প্রলোভন দিয়ে থাকে। এই চক্রটি তিন স্তরের। প্রথম স্তরে থাকে গ্রামের লোকজন, যারা দরিদ্র মানুষকে ঋণের ফাঁদে ফেলে কিডনি বিক্রি করতে রাজি করায়। দ্বিতীয় স্তরে ঢাকার কিছু হাসপাতাল ও কর্মীরা আছে যারা এসব ব্যক্তিদের থাকার ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করে। চক্রের তৃতীয় স্তরে রয়েছে ভারত, দুবাই এবং সিঙ্গাপুরের লোকজন যারা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসব দরিদ্র লোকদের নিয়ে কাজ করে।

কিডনি বিক্রির পর একজন কিডনি দাতা সাধারণত গ্রহীতাকে দেখেন না। উলিপুর গ্রামের এক বাসিন্দা, যিনি ভ্যান চালাতেন, এমনই একজন ছিলেন। তিনি দিল্লিতে গিয়ে এক কিশোরকে কিডনি দেন, তবে কিশোরকে কখনো চোখে দেখেননি।

যারা ফিরে আসে, তারা সুস্থ নয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ রফিকুল আলম জানিয়েছেন, কিডনি দাতাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন। তবে কালাইয়ের যারা ভারতে গিয়ে কিডনি দিয়ে এসেছেন, তাদের জন্য সেখানে আবার যাওয়া কঠিন। অনেকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং অনেকেই গোপন রাখতে চান যে তারা কিডনি বিক্রি করেছেন।

কালাই উপজেলার বোড়াই গ্রামের এক ব্যক্তি ২০১০ সালে কিডনি বিক্রি করেছিলেন, এখন তিনি কোমরের ব্যথা নিয়ে চলছেন। ভেরেন্ডি গ্রামের আরেকজন ব্যক্তিও শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। এদের অনেকেই শারীরিক কাজ করতে পারেন না, অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

Maniruzzaman

I am Maniruzzaman, a free thinker and political commentator, dedicated to unraveling the complexities of Bangladesh’s political landscape.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button