কিডনি বিক্রি করে কোটিপতি, বাড়ছে মৃত্যুর হার, চক্রের সাথে সরাসরি জড়িত সচিব, প্রতিকার কার কাছে?
মনিরুজ্জামান
আমাদের অনুসন্ধানের ২য় পর্যায়ে এসে আমরা যাই পাঁচবিবি উপজেলায়। সেখানে সন্ধান মেলে শাকিল হোসেনের। অভাবের তাড়নায় পাঁচ বছর আগে নিজের কিডনি বিক্রি করেছিলেন শাকিল হোসেন। এখন তিনি কিডনি বিক্রি-বাণিজ্যের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েছেন, গ্রামের আশপাশের মানুষদের কিডনি বিক্রি করতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
শাকিল শুধু নিজেই কিডনি বিক্রি করেননি; তিনি গ্রামবাসীদেরও মোটা অংকের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি বিক্রির দিকে আকৃষ্ট করছেন। এমনকি আগাম অর্থ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। পাঁচবিবি উপজেলার আব্দুল বাহাপুর গ্রামের বাসিন্দা শাকিলকে নিয়ে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, পাঁচ বছর আগে শাকিল অর্থকষ্টে পড়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন। এরপর তিনি গ্রামবাসী সবুজ হোসেনকে (ডিবজল) টাকার লোভ দেখিয়ে কিডনি বিক্রিতে রাজি করান এবং দেড় লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন, তবে সবুজের কিডনি বিক্রি আর হয়নি। এরই মধ্যে সবুজের পরিবারকে ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা তুলে দিতে হয়েছে।
সবুজের শাশুড়ি আজিমন বেগম বলেন, “ঋণ করে এবং মেয়ে-জামাইয়ের ভিটা বিক্রি করে শাকিলকে টাকা দেওয়া হয়, কিন্তু সবুজ কিডনি বিক্রির সুযোগ না পেয়ে এখন ভাড়ার ঘরে বসবাস করছে।”
স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, শাকিল প্রথমে গ্রামেরই বুলবুল নামের এক যুবককে কিডনি বিক্রির প্রস্তাব দেন এবং ঢাকায় নিয়ে যান। কিন্তু পরে বুলবুল শাকিলের খপ্পরে না পড়ে ঢাকায় রিকশা চালাতে শুরু করেন।
পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নুরুল আমিন জানান, “প্রতিটি মানুষের শরীরে দুটি কিডনি থাকে। একটি কিডনি দিয়ে জীবনযাপন করা সম্ভব হলেও শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হতে পারে।”
পাঁচবিবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়সাল বিন আহসান বলেন, “কিডনি কেনাবেচার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থানায় আসেনি। তবে কোনো আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।”
চলছে রমরমা কিডনি বাণিজ্য
আব্বাস মিয়া (৪৫) নিজের কিডনি বিক্রি করে কিডনি বিক্রির একটি চক্র গড়ে তুলেছেন। তার মাধ্যমে অনেক মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন, কিন্তু আব্বাসের অভাব কমেনি; এখন তিনি স্ত্রীর কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া করছেন। আব্বাস গুরুদাসপুর পৌর শহরের আনন্দ নগর মহল্লার বাসিন্দা।
আব্বাসের কিডনি বিক্রির শুরু হয়েছিল ঋণ পরিশোধের জন্য। এখন এটি একটি বাণিজ্যিক চক্রে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, মানুষ আব্বাসের খপ্পরে পড়ে দালাল খুঁজে কিডনি বিক্রি করছে। বিগত দশ বছরে প্রায় ৫০ জন ব্যক্তি তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন।
আমাদের অনুসন্ধানে গুরুদাসপুরের কিডনি বিক্রির ভয়াবহতা উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের জুন মাস থেকে চলতি বছরের ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৮ জন তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে দুই জন স্থানীয় ক্রেতা দুইটি কিডনি কিনেছেন, এবং বাকি ছয়টি কিডনি অন্য এলাকায় বিক্রি হয়েছে। কিডনি বিক্রিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চক্রের মাধ্যমে এসব কিডনি বিকিকিনি হয়েছে। তবে প্রশাসনের তরফে কিডনি বিক্রির এই চক্রটি রোধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রিপন দাস জানান, গত ছয় মাসে তিনি কিডনি সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি তদন্ত করেছেন। দাতারা যে ঠিকানা ব্যবহার করছেন, বাস্তবে তার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। একটি সাম্প্রতিক তদন্তে ছাবলু রহমান নামের একজনের তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু তার ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছে।
আব্বাস মিয়া প্রথমে নিজের কিডনি বিক্রি করে গুরুদাসপুরে বেআইনি অঙ্গ বিক্রির অধ্যায় শুরু করেন। নিজে কিডনি বিক্রির পর, তিনি এলাকার অভাবী মানুষদেরও কিডনি বিক্রি করতে উৎসাহিত করেন। তার মাধ্যমে প্রায় ২০ জন লোক একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন।
আব্বাস জানান, প্রায় ১৮ বছর আগে অভাবের কারণে তিনি কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। এখন স্ত্রীকে কিডনি বিক্রি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কিডনি দাতা ও মধ্যস্থতাকারীরা জানান, সুস্থ একটি কিডনি বিক্রি করলে ৪ থেকে ৪.৫ লাখ টাকা পাওয়া যায়। দালালদের মাধ্যমে কিডনি বিক্রির পর দাতাদের জন্য ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এভাবে গুরুদাসপুরের কিডনি ব্যবসা চলছে।
দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে দাতাদের গোপনে ঢাকায় নেওয়া হয়। সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপন করার জন্য তথ্য গোপন করে কাজ করা হয়।
অনুসন্ধান অনুযায়ী, গুরুদাসপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন। আব্বাসের মাধ্যমেই তাদের অনেকেই কিডনি বিক্রি করেছেন এবং কিনেছেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় এক কিডনি বিক্রেতা জানান, তিনি রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও টাকার জন্য কিডনি বিক্রি করেছেন। কিডনি বিক্রির পর ভারী কাজ করতে পারেননি।
গুরুদাসপুর থানার ওসি মো. মোনোয়ারুজ্জামান বলেন, “অভিযোগের অভাবে এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।”
৪–৫ লাখ টাকায় কিডনি কিনে বিক্রি করতেন ৫০ লাখে, ভারত থেকে ফিরে শুরু প্রতারণা
পাঁচ বছর আগে ভারতে গিয়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন আনিছুর রহমান। তিনি বুঝতে পারেন, দেশটিতে কিডনির চাহিদা ব্যাপক। পরবর্তীতে ভারতের কিডনি বেচাকেনা চক্রের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশে একটি চক্র গড়ে তোলেন তিনি। এই চক্রটি গ্রামের মানুষের কাছ থেকে ৪–৫ লাখ টাকায় কিডনি কিনে তা অন্তত ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করত। এভাবে দেশ-বিদেশে তারা ৫০টি কিডনি বিক্রি করেছে।
২০১৯ সালে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ভারতে গিয়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন আনিছুর। পরে ভারতে কিডনির চাহিদা দেখে দেশটির চক্রের সঙ্গে মিলে ঢাকায় একটি চক্র গড়ে তোলেন তিনি। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালের মাধ্যমে কিডনি কিনতেন তাঁরা।
তাঁরা দেশের বিভিন্ন কিডনি হাসপাতালে গিয়ে কিডনি দরকার এমন বিত্তশালী রোগী খুঁজে বের করতেন। এরপর দরদাম ঠিক হওয়ার পর ভারত, থাইল্যান্ড ও দুবাইসহ রোগীর চাহিদামতো দেশের হাসপাতালে তাঁদের কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা হতো। দেশ-বিদেশে তাঁরা ৫০টি কিডনি বেচাকেনা করেছেন।
৩ লাখ টাকার কিডনি বিক্রি ৫০ লাখ
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে মিরপুর-১০ নম্বরের শাহ আলী মার্কেটের পেছনে বসে এক বন্ধুর সঙ্গে চা খেতে খেতে সাংসারিক অভাব-অনটন নিয়ে কথা বলছিলেন রবিন খান। তাদের পাশে বসে থাকা মাছুম এসব কথা শুনে জানান, এক্ষেত্রে তিনি সাহায্য করতে পারবেন। ভারতে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৫ দিন রবিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রেখে তাকে ভারত যেতে রাজি করান তিনি।
পরবর্তীতে রবিনকে ধানমণ্ডির ল্যাবএইডে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান মাছুম। সেখানে রাজু, শাহেদ ও আতাউরের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পাসপোর্ট-ভিসা কার্যক্রম শেষে গত বছর ২২ ডিসেম্বর রবিন ইনডিগো এয়ারলাইনের একটি বিমানে ভারতের দিল্লি পৌঁছান। সেখানে একই চক্রের দুই সদস্য শাহীন ও মোস্তফা রবিনকে দিল্লির ফরিদাবাদে নিয়ে যান। সেখানে একটি বাসায় ২০-২৫ দিন আটকে রেখে কিডনি বিক্রির জন্য রবিনের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন তারা।
রবিনকে তারা বোঝান, মানুষ একটি লিভার, একটি হার্ট দিয়ে বাঁচতে পারলে একইভাবে একটি কিডনি দিয়েও বাঁচতে পারে। একদিকে মানসিক চাপ, অন্যদিকে টাকা-পয়সার প্রলোভন দেখিয়ে অবশেষে এক রকমের বাধ্য করে ভারতের গুজরাটের মুক্তিনগরের একটি হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে স্থানীয় ডাক্তারের সাহায্যে রবিনের কিডনি বিক্রি করে দেয় চক্রটি।
এর চারদিন পর হাসপাতালে ছাড়া পেয়ে রবিন জানতে পারে তার কিডনি ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে চক্রটি। প্রায় অর্ধকোটি টাকায় কিডনি বিক্রি করলেও রবিনকে দেয়া হয় মাত্র ৩ লাখ টাকা। পরে দেশে ফিরে রবিন জানতে পারেন, একই চক্রটি তার পরিচিত একজনকে এভাবে ফুসলিয়ে ভারত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নিজের যে ক্ষতি হয়েছে, তা যেন অন্য কারো না হয় সেজন্য রবিন ধানমণ্ডি থানায় চক্রটির বিরুদ্ধে মামলা করেন।
বর্তমানে কিডনি হারিয়ে কর্মক্ষমতাহীন অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন রবিন। কিডনি অপারেশনের ফলে তার পেটে ৫ ইঞ্চি পরিমাণ একটি কাটা দাগ রয়েছে। একটি কিডনি হারিয়ে বর্তমানে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
দালাল চক্রের একাদিক সদস্যের সাথে কথা বলে যানা যায় সাইফুল ইসলাম নামে চক্রের এক গডফাদারের কথা। মুলত সাইফুল ইসলাম এই সকল স্থানীয় দালালদের পরিচালনা করেন। এবং যে সকল ডাক্তার এই চক্রের সাথে জরিত তাদের মধ্যে অন্যতম “স্বাধীনতা ডক্টর’স এসোসিয়েশনের” সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার মন্জুর আলম,ডাক্তার নাজমুল হাসান,ডাক্তার আব্দুর রব সহ আরো অনেক ডাক্তার চক্রের সাথে জরিত বলে জানা যায়। আর এই পুরো চক্রটিকে জিনি পরিচালনা করেন বলে আমরা তদন্ত করে পাই তিনি বাংলাদেশের বর্তমান সাস্থ্য সচিব জাহাঙ্গীর আলম। মুলত তার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে চক্রটি এমন একটি অবৈধ কাজ বছরের পর বছর পরিচালনা করে আসছে।